শুরুর_কথাঃ ১৯৭০ সালের আগে সারা পৃথিবীতে মাত্র ৯ টি দেশে ডেঙ্গুঁর তীব্র প্রকোপ ছিল,
★ এখন তা ১০০ টি দেশে ছড়িয়ে গেছে! এখন প্রতিদিন প্রায় ৪০০ জন নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে।
★ এবছরে জানুয়ারি থেকে অদ্যবদি প্রায় ৭,৭০০ জন ডেংগুতে আক্রান্ত হয়েছে।
আতংক নয়, সচেতনতাই এর প্রতিকার ও প্রতিরোধে কাজে আসতে পারে।

#ডেংগু_কি?
এডিস মশা বাহিত ডেংগু নামক ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত এক প্রকারের জ্বর
যা লক্ষন সহ বা লক্ষনবিহীন হতে পারে।

#ডেংগুর_সময় :

★ বাংলাদেশে বর্ষাকালে সাধারণত জুন থেকে অক্টোবর ডেংগু ছড়ানোর মূল সময়।
★ ( প্রধানত আগষ্ট থেকে সেপ্টেম্বর এর প্রকোপ বেশী হয়ে থাকে)

#ডেংগুর_বাহক_VECTOR

★ ডেঙ্গুঁ রোগের দুটো বাহক/ ভেক্টর
Aedes aegypti এবং Aedes albopictus.
★ Aedes agypti সাধারনত ঘর বাড়িতে জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে।
★ অন্যদিকে Aedes albopictus সাধারনত প্রকৃতিতে জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে(যেমন: গাছের খোলস, বাঁশ গাছের ভেতর) ডিম পাড়ে।
★ শহর এলাকায় ডেঙ্গুঁ রোগের প্রধান বাহক হল Aedes aegypti মশা, তবে চট্টগ্রামে Aedes albopictus পাওয়া গেছে।
★ অন্যদিকে, বর্তমানে আর্থসামাজিক অবস্হান & পরিবেশের পরিবর্তনের কারনে গ্রামেও Aedes aegypti ছড়িয়ে পড়ছে!
★ এই মশার আলো পছন্দ এবং আলোতে ( দিনের আলোয়/ ল এরা কামড়ায়।
★ শহরে পরিস্কার জমে থাকা পানি (ফুলের টবে, পান পাত্র, ফ্রিজে বা বাথরুমে জমানো পানি ৫ দিনের বেশী) এবং আলো বেশি হাওয়ায় শহরে বেশি হয়।

অবাক করার বিষয় হল যেই শহরে একবার ডেঙ্গু ঢুকবে সেটা দূর করা কষ্টসাধ্য, কারন —
💥💥 এছাড়া এডিস মশকীর ডিম ১ বছর পর্যন্ত উপযোগী শুকনো পরিবেশে অক্ষত থাকতে পারে এবং এরপর পরিষ্কার পানির সংস্পর্শ পাওয়া মাত্র ২৪ ঘন্টার মধ্যে ডিম থেকে বাচ্চা ফুটতে পারে!
💥💥ডেংগু ভাইরাস মা মশা থেকে বাচ্চার মধ্যে ছড়াতে পারে।

#বহুরপী_ডেংগু_ভাইরাস ঃ

Dengue Virus এর চারটি সেরোটাইপ আছে। প্রতিটি সেরোটাইপ এর আবার কয়েকটি করে সাব-টাইপ/জেনোটাইপ আছে। যেমন:

DENV-1: Three
DENV-2: Two (one is non-human primate)
DENV-3: Four
DENV-4: Four (one is non-human primate)
(DENV = DENgue Virus).
এই বহুরূপী চেহারার জন্য
ডেঙ্গুঁর কার্যকর কোনো ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করা সম্ভব হচ্ছে না।

★ ডেঙ্গুঁ ভাইরাসের কোনো সেরোটাইপ এর বিরুদ্ধে একবার এন্টিবডি তৈরি হলে সেটা আজীবন রোগ প্রতিরোধ করে এবং অন্যান্য সেরোটাইপ এর বিরুদ্ধে কয়েক মাসের জন্য আংশিক প্রতিরোধ ক্ষমতা দেয়।
★ এজন্যই হয়ত এক সিজনে একবার ডেঙ্গুঁ হলে সেই সিজনে সাধারনত দ্বিতীয় বার ডেঙ্গুঁ আক্রান্ত হতে শুনি না আমরা!
★ তবে ভয়ানক তথ্য হল, উপদ্রুত এলাকাতে একই সাথে রক্তে চার ধরনের সেরোটাইপই পাওয়া যেতে পারে।
★ আমাদের দেশে এবার শোনা যাচ্ছে, DENV-3 দিয়ে বেশি ডেঙ্গুঁ হচ্ছে।
★ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এবং শ্রীলংকা তে Dengue Fever এর জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই DENV-3 সেরোটাইপ এর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে!

#ডেংগু_ভাইরাস_কিভাবে_রোগ_তৈরী_করে?

★ ডেংগু ভাইরাস শরীরে ঢুকলেই আমাদের T-cell activated হয়ে উঠে.আর activated হয়ে ফাইট দেয়ার সময় chemical mediator রিলিজ করে যার জন্য Dengue hemorragic fever হয়।
★ ব্লাড ভেসেলের ক্যাপিলারি সমূহে ক্ষতিগ্রস্ত করে, এর কারণে রক্তনালির ছিদ্রপথ তৈরি হয়, তখন plasma fluid সমূহ blood vessel থেকে বেরিয়ে যায়.. যাকে plasma leakage বলে। এতে blood pressure কমে জীবন ঝুকিপূর্ণ হতে পারে।
★ রক্তের অণুচক্রিকা /Platelets কমে যায়।
অনুচক্রিকার জীবনকাল ৫ – ৮ দিন হওয়ায় ডেংগু ইনফেকশনের ৫ দিন পর থেকে platelet কমতে শুরু করে,
সমস্যা হল এর মাঝে জ্বর কমে গেলে রোগী আশ্বস্ত বোধ করে, কিন্তু এই সময়টাই সবচেয়ে বিপদজনক।

#ডেংগুর_জীবানু_শরীরে_প্রবেশঃ

★ মশকীর শরিরে প্রবেশের পর ডেঙ্গুঁ ভাইরাসের সুপ্তাবস্হা ৪-১০ দিন। অর্থাৎ ৪-১০ দিনের মাঝে মশা ইনফেক্টেড হয়।
★ মানুষের শরিরে প্রবেশের পর ডেঙ্গুঁ ভাইরাসের সুপ্তাবস্হা ৪-৭ দিন (৩-১৪ দিন)।
অর্থাৎ ৩-১৪ দিনের মাঝে মানুষ ইনফেক্টেড হয়।

#ডেংগুর_লক্ষ্মণ_কি?

★ ডেংগু ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলে

১/ কোন লক্ষ্মণ নাও থাকতে পারে
(Asymptomatic) – বেশির ভাগ সময়ে এটা হয়।
এতে Fever, Rash, Bodyache এগুলো সবসময় নাও থাকতে পারে! বিশেষ করে ১৫ বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এমনটা বেশি দেখা যায়।

২/ লক্ষ্মণ /উপসর্গ তৈরি করতে পারে ( Symptomatic).
ডেংগু ভাইরাস ইনফেকশন হলে ৪ ধরনের উপসর্গ তৈরী করতে পারে।
ক) অনির্দিষ্ট জ্বর / Undifferentiated Fever.
খ) নির্দিষ্ট ডেংগু জ্বর /Dengue Fever.
ডেঙ্গুঁর জ্বর সাধারনত ২-৭ দিন থাকতে পারে।
বাইফেজিক প্যাটার্নের এর ফিভার হওয়ায় অনেকে হয়ত ভুল করে সেকেন্ড ইপিসোড কেই ফার্স্ট ইপিসোড বলতে পারেন! সাধারনত জ্বরের ৩-৪ দিন পর rash দেখা দেয় যা maculopapular/rubelliform দেখতে।
তবে জ্বরের প্রথমদিনই rash উঠেছে এবং ১৪ দিন পর্যন্ত ছিল এমন ডেঙ্গুঁ কেইসও পাওয়া গেছে।
গ) রক্তক্ষরন ডেংগু জ্বর / Dengue Haemorrhagic Fever –
4) সম্প্রসারিত ডেংগুর উপসর্গ সমূহ / Expanded Dengue Syndrome

#ডেংগুর_চিকিৎসা/Management :

চিকিৎসার জন্য ডেংগু ভাইরাস ইনফেকশনের রোগীকে ৩ টি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়-

★ গ্রুপ-A :
যাদের কোন বিপদ চিহ্ন নেই।
এদের বাসায় ম্যানেজ করলেই হবে-
পর্যাপ্ত পানি, ORS, জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ঔষধ। DICLOFENAC জাতীয় ঔষধ দেয়া যাবে না।

★ গ্রুপ- B :
ক্রিটিক্যাল ফেইজে যাদের বিপদ চিহ্ন সমূহ থাকবে –
১/জ্বর ভালো হবার সাধারণত ৪-৭ দিন পর,
২/ বমি, পেট ব্যথা,
৩/ অস্হিরতা ও এলোমেলো আচরণ করা
৪/ রক্ত ক্ষরণ হয়া,
৫/ ঠান্ডা হাত-পা, প্রসাব না হওয়া,
৬/ লিভার বড় হয়ে যাওয়া,
৭/ হেমাটোক্রিট ২০% এর বেশী
৮/ অন্যান্য সমস্যা যেমন গর্ভবতী, বৃদ্ধ, ডায়াবেটিস, হার্ট, কীডনী, হেপাটিক ফেইলুর, হাইপারটেনশন ইত্যাদির রোগী।
এদের হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।

★ গ্রুপ- C :
যাদের শক বা পানি জমার জন্য শ্বাসকষ্ট, মস্তিষ্ক ও হার্টের সমস্যা তৈরী, মেটাবলিক এবনরমালিটি এসিডোসিস, হাইপোক্যালসেমিয়া থাকবে।
এদের হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।

#ডেঙ্গুজ্বর_প্রতিরোধের_উপায়ঃ

ডেঙ্গুর কোনো ভ্যাক্সিন নেই।
যেহেতু ডেঙ্গু ভাইরাস চার টাইপের, তাই এই চারটি ভাইরাসের প্রতিরোধে কাজ করে, এমন ভ্যাক্সিন আবিষ্কৃত হয়নি।
★ তাই ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধের মূলমন্ত্রই হলো এডিস মশার বিস্তার রোধ এবং এই মশা যেন কামড়াতে না পারে, তার ব্যবস্থা করা।
★মনে রাখতে হবে, এডিস একটি ভদ্র মশা, অভিজাত এলাকায় বড় বড় সুন্দর সুন্দর দালান কোঠায় এরা বাস করে।
স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে এই মশা ডিম পাড়ে।
ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত ড্রেনের পানি এদের পছন্দসই নয়।

তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশার ডিম পাড়ার উপযোগী স্থানগুলোকে পরিষ্কার রাখতে হবে এবং একই সাথে মশক নিধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এই রোগ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো ব্যক্তিগত সতর্কতা এবং এডিস মশা প্রতিরোধ।

🔸#ব্যক্তিগত_সতর্কতা:

ডেঙ্গু প্রতিরোধে ব্যক্তিগত সতর্কতার গুরুত্ব অপরিসীম।
মনে রাখতে হবে এডিস মশা মূলত দিনের বেলা, সকাল ও সন্ধ্যায় কামড়ায়, তবে রাত্রে উজ্জ্বল আলোতেও কামড়াতে পারে। তাই –
➡️দিনের বেলা যথাসম্ভব শরীর ভালোভাবে কাপড়ে ঢেকে রাখতে হবে, পায়ে মোজ ব্যবহার করা যেতে পারে।
➡️বাচ্চাদের হাফপ্যান্টের বদলে ফুলপ্যান্ট বা পায়জামা পড়াতে হবে।
➡️ মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য দিনে ও রাতে মশারী ব্যবহার করতে হবে। দরজা-জানালায় নেট লাগাতে হবে।
➡️প্রয়োজনে মসকুইটো রিপেলেন্ট, স্প্রে, লোশন বা ক্রিম, কয়েল, ম্যাট ব্যবহার করা যেতে পারে।

🔸#বসতবাড়ির_মশা_নিধন:

যেহেতু এডিস মশা মূলত এমন বস্তুর মধ্যে ডিম পাড়ে যেখানে স্বচ্ছ পানি জমে থাকে, তাই-
➡️ ফুলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, বাড়িঘরে এবং আশপাশে যেকোনো পাত্র বা জায়গায় জমে থাকা পানি ৩ থেকে ৫ দিন পরপর ফেলে দিলে এডিস মশার লার্ভা মারা যাবে।
➡️ পাত্রের গায়ে লেগে থাকা মশার ডিম অপসারণে পাত্রটি ঘষে পরিষ্কার করলে ভালো ।
➡️ ঘরের বাথরুমে কোথাও জমানো পানি ৫ দিনের বেশি যেন না থাকে।
➡️ একুরিয়াম, ফ্রিজ বা এয়ার কন্ডিশনারের নিচে এবং মুখ খোলা পানির ট্যাংকে যেন পানি জমে না থাকে সে ব্যবস্থা করতে হবে।
➡️ বাড়ির ছাদে অনেককে বাগান করতে দেখা যায়, সেখানে টবে বা পাত্রে যেনো জমা পানি ৫ দিনের বেশি না থাকে, সেদিকেও যত্নবান হতে হবে।
➡️ বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

🔸#বসতবাড়ির_বাইরে_মশার_বংশ_বিস্তার_রোধ

➡️ ঘরের বাইরে মাঝে মাঝে বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টি হওয়ার ফলে পানি জমতে পারে। যেমন: ফুলের টব, প্লাস্টিকের পাত্র, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের ড্রাম, মাটির পাত্র, টিনের কৌটা, ডাবের খোসা, কন্টেইনার, মটকা, ব্যাটারির শেল, পলিথিন/চিপসের প্যাকেটে জমে থাকা পানি পরিষ্কার করতে হবে।
➡️ মশা নিধনের জন্য স্প্রে বা ফগিং করতে হবে।
➡️ বিভিন্ন রাস্তার আইল্যান্ডে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ফুলের টব, গাছপালা, জলাধার ইত্যাদি দেখা যায়। এখানে বৃষ্টির পানি জমে থাকতে পারে। সেগুলোতেও যেনো পানি জমে না থাকে, সে ব্যপারে যত্নবান হতে হবে।

#শেষকথাঃ

পরিশেষে বলা যায়,
★ ডেঙ্গুজ্বর হয়তোবা নির্মূল করা যাবেনা,
★ এর কোনো ভ্যাক্সিন কিংবা কার্যকরী ঔষধও আবিষ্কৃত হয়নি।
ডেঙ্গুজ্বরের মশাটি আমাদের দেশে আগেও ছিল, এখনও আছে, মশা প্রজননের এবং বংশবৃদ্ধির পরিবেশও আছে।
তাই ডেঙ্গুজ্বর ভবিষ্যতেও থাকবে।
একমাত্র সচেতনতা ও প্রতিরোধের মাধ্যমেই এর হাত থেকে মুক্তি সম্ভব।
মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে সুস্থ রাখুন।