সাইফুল ইসলাম রিয়াদ: দেশের জন্য লড়াই করে পাহাড়ে জীবন দিলো আরেক সেনাসদস্য। নিহত সেনা সদস্য রফিকুল ইসলাম (৩৭) নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার পরকোট ইউনিয়নের পশ্চিম শোশালিয়া গ্রামের আমজাদ আলী কাইদার বাড়ির মফিজ উদ্দীন ও হায়াতুন্নেছা দম্পতির চতুর্থ সন্তান। তিনি সেনাবাহিনীতে কর্পোরাল হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
শনিবার (২০ এপ্রিল) সন্ধ্যায় নিহত সেনা সদস্য রফিকুল ইসলামের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে আনার সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছে তার স্বজনেরা।
পারিবার বলছে, বান্দরবানের রুমায় সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) গুলিতে নিহত হয়েছেন তিনি। শুক্রবার বিকালে রুমা উপজেলার বড়থলি পাড়া আর্মি ক্যাম্পের আওতাধীন পলি পাংশা পাড়ার মধ্যবর্তী স্থানের যাত্রীছাউনি এলাকায় গুলিতে নিহত হন এই সেনা সদস্য।
শনিবার (২০ এপ্রিল) তার পরিবারের সদস্যরা চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে মরদেহ গ্রহণ করে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসেন। সন্ধ্যায় তার মরদেহ গ্রামের বাড়ি এসে পৌঁছালে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা। রাত আটটায় জানাজা শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
এর আগে শুক্রবার রাতে মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে বাড়িতে শুরু হয় শোকের মাতম। স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠে গ্রামের পরিবেশ।
সন্ধ্যায় রফিকুল ইসলামের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, কাপড়ে মুখ ঢেকে কাঁদছেন স্ত্রী আমেনা বেগম। পাশেই অপলক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলছে অবুঝ তিন শিশু। মা কেন কান্না করছে, তা তখনো বুঝতে পারেনি তাফহীম (১২), তাহমীদ (১১) ও ফারহান (৩)। বাকরুদ্ধ হয়ে ঘরের মধ্যে বিছানায় শুয়ে কাঁদছেন নিহত সেনা সদস্যের মা হায়াতুন্নেছা। আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা ছিল না তাদের। সবার চোখেই পানি ঝরছিল।
পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, দেশ মাতৃকার টানে ২০০৫ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে যোগ দেন রফিকুল ইসলাম। শুক্রবার বিকালে রুমা উপজেলার পলি পাংশা পাড়ার যাত্রীছাউনি এলাকায় কেএনএফের সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হন রফিকুল। তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেওয়া হলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
বাবার লাশ আসার আগে তার তিন সন্তান তাফহীম (১২), তাহমীদ (১১) ও ফারহানকে (৩) স্বাভাবিক দেখা গেলেও লাশ দেখার পর থেকে অঝোরে কান্না শুরু করে বড় দুই সন্তান। পুরো জানাজায় ইমামের পেছনে প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছেন করপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া তাফহীম ও চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া তাহমীদ।
নিহতের স্ত্রী আমেনা বেগম বলেন, ‘২০১১ সালে আমাদের বিয়ে হয়েছিল। রোজার আগে সবশেষ বাড়িতে এসেছিলেন তিনি। সবশেষ পড়শু কথা হয়েছে। শুক্রবার রাতে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ফোন করে মৃত্যুর খবর জানানো হয়। আজ সকালে আমার শ্বশুর গিয়ে মরদেহ নিয়ে এসেছেন। আমার তিন ছেলে। আমার পরিবারে আর কেউ উপার্জনক্ষম নেই। তিন ছেলেকে নিয়ে আমি এখন কীভাবে চলবো? আমাদের দেখার আর কেউ রইলো না।’ বলে কান্না শুরু করেন আমেনা।
বিলাপ করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন রফিকুল ইসলামের বড় বোন মফিদা আক্তার। তিনি বলেন, ‘আমার ভাই নিজের সংসারের পাশাপাশি আমাদেরও খেয়াল রাখতো। আমরা এখন কি নিয়ে বাঁচবো? আমার ভাতিজাদের কে দেখবে? সবকিছু শেষ হয়ে গেলো।’
রফিকুলের আরেক বোন শাহিন আক্তার বলেন, ‘আমার সোনার টুকরো ভাইকে হারিয়ে ফেলেছি। ও ভাই, কেন আমাদের ছেড়ে চলে গেলি। আমাদের এখন কে দেখবে? কে সংসার চালাবে? কে আমাদের বৃদ্ধা মায়ের ওষুধ খরচ দেবে?’
চাটখিল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দীন বলেন, ‘চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে শুক্রবার রাতে আমাকে ফোন করে তার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য নেওয়া হয়েছিলো। পরে স্বজনদের কাছ থেকে মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত হয়েছি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তার পরিবারের পাশে থাকবে। আমরাও তাদের খোঁজ খবর রাখবো।’