ক্রীড়া প্রতিবেদক : মাঝে শুধু নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে একটি স্ট্যাটাস দেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ব্যস, ওইটুকুই। রাজনীতি নিয়ে এর বাইরে একেবারে ‘স্পিকটি নট’ মাশরাফি বিন মর্তুজা। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ যখন নিঃশ্বাস দূরত্বে, তখন আর চুপ থাকেন কিভাবে! যে ক্রিকেটকে জীবনের ধ্রুবতারা জেনে এসেছেন ১৮ বছর ধরে, এর গায়ে রাজনীতির ছোপ তো লাগতে দিতে চান না মাশরাফি।
কাল তাই ‘রাজনীতিবিদ’ মাশরাফি সংবাদ সম্মেলন করেন। যেন ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে সিরিজের মাঝে এ নিয়ে আর কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি না হতে হয়। ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত অন্তত তিনি শতভাগ ক্রিকেটার। ক্রিকেটের মাঠ থেকে রাজনীতির মঞ্চে যাওয়ার ব্যাপারটা তোলা রইল এই দিন দশের জন্য।
‘বিশ্বকাপ পর্যন্ত জাতীয় দলে খেলব ধরলে বাকি সাত-আট মাস। তখন ক্যারিয়ার শেষ হলে পরের সাড়ে চার বছরে কী হবে, আমি জানি না। এখন আমার সামনে সুযোগ এসেছে মানুষের সেবা করার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে সে সুযোগ দিয়েছেন। এলাকার মানুষের জন্য কাজ করার জন্য এটি খুব ভালো সুযোগ বলে আমার মনে হয়েছে’—নিজের রাজনীতিতে আসার কারণটা এভাবেই জানান মাশরাফি। নড়াইল-২ আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী তিনি। তবে সংসদ নির্বাচনের বাকি প্রার্থীরা যখন নাওয়া-খাওয়া হারাম করে ভোটের ময়দানে, মাশরাফি তেমনটা নন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের তিন ম্যাচ ৯, ১১ ও ১৪ ডিসেম্বরেই তাঁর পূর্ণ মনোযোগ, ‘নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কারণে খেলার প্রতি ফোকাস একদমই কমছে না। পুরো মন দিয়ে অনুশীলন করছি। ১৪ ডিসেম্বর খেলা শেষের পর রাজনীতিতে মনোযোগ দেব। এর আগের মনোযোগ পুরোপুরি খেলায়।’
সংবাদ সম্মেলন ঢের করেছেন মাশরাফি। জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হতে হয় প্রায়ই। তবে কালকের এই সংবাদ সম্মেলন একেবারে ভিন্ন। যেহেতু নিজের রাজনৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যা করার জন্য, সে কারণে স্টেডিয়ামের সংবাদ সম্মেলনকক্ষ ব্যবহার করেননি। কথা বলেননি মাঠেও। স্টেডিয়াম চত্বরে পুলিশ বক্সে দাঁড়িয়ে সংবাদ সম্মেলন করে যান মাশরাফি। ক্যারিয়ার শেষের দিকে হওয়ায় রাজনীতির মাঠে নাম লেখানোর কথা বললেও ২০১৯ বিশ্বকাপেই যে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি টানবেন, অমনটা স্পষ্ট করে বলেননি, ‘চ্যাম্পিয়নস ট্রফির (২০১৭ সাল) পর আর খেলতে পারব কি না, তখন জানতাম না। এরপর ফিটনেস-ফর্ম সব ঠিক থাকায় ২০১৯ বিশ্বকাপ পর্যন্ত খেলার ব্যাপারে এগিয়েছি। এরপর আর খেলব কি না, ভেবে দেখার সুযোগ আছে। যদি খেলার মতো অবস্থায় না থাকি, তাহলে তো ছেড়ে দিতেই হবে। আর যদি সে অবস্থা থাকে, তাহলে অবশ্যই আমি চেষ্টা করব। অবশ্য তার আগেও যেকোনো কিছু হতে পারে। ২০১১ বিশ্বকাপের পর আপনাদের ৫০ পারসেন্টই বিশ্বাস করেছিলেন যে আমার ক্যারিয়ার শেষ। আরো সাত বছর তো খেললাম।’
বিদায়ের নির্দিষ্ট দিন-ক্ষণ না বললেও সে সময় যে এসেছে, তা বোঝেন মাশরাফি। আর সেই শেষের কথা বলতে গিয়ে একটু যেন অভিমানও ভর করে তাঁর কণ্ঠে, ‘আমি শচীন টেন্ডুলকার অথবা গ্লেন ম্যাকগ্রা নই যে আমার কথা মানুষ স্মরণ রাখবে। আমি আমার মতো করেই ক্রিকেটটা খেলেছি। কষ্ট করে করে যতটুকু পেরেছি, খেলেছি।’ অভিমান হয়তো নিজের দুর্ভাগ্যের প্রতি; ইঙ্গিতটা হয়তো নিজের ইনজুরির দিকে। তবু তো বাংলার আপামর জনতার ভালোবাসা পেয়েছেন। রাজনীতির মাঠে নামার পর সে ভালোবাসায় যে ভাঙন ধরবে, তাও টের পেয়েছেন। পুরো দেশের মাশরাফি থেকে একটি রাজনৈতিক দলের মাশরাফি হয়ে যাওয়ায় জনতার প্রতিক্রিয়া তাঁর কাছে অস্বাভাবিক না, ‘এটা খুবই স্বাভাবিক। আমার উদ্দেশ্য পরিষ্কার—মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। আগেও বললাম, বিশ্ব ক্রিকেটে আমি এমন কোনো সুপারস্টার নই যে আট মাস পরে আমি যখন খেলা ছেড়ে দেব তখন জনে জনে মানুষ স্মরণ করবে।’
ক্রিকেটার মাশরাফি তো শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি মাশরাফিও। তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ থাকতেই পারে। সেটি প্রকাশ্যে আসায় কোনো সমস্যা দেখেন না তিনি, বরং সমালোচনার স্রোতেও অটল নিজের বিশ্বাসে, ‘প্রত্যেকের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব থাকা উচিত। যদি কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করেন, তাহলে তা প্রকাশ্যে বলা উচিত। কিন্তু এমন অনেকে আছেন, যাঁরা হয়তো এক দলকে সমর্থন করেন কিন্তু বলতে পারেন না। আমি মনে করি, প্রত্যেকে যে দলকেই সমর্থন করুন, তাঁর প্রতি অন্যদের সম্মান থাকা উচিত।’ কিন্তু রাজনীতি যে অমন সরলরৈখিক পথে চলে না, সেটি মাশরাফির না জানার কারণ নেই। তবু নিজের লক্ষ্যের জায়গায় মানুষকে সেবা করাকেই দিচ্ছেন প্রাধান্য, ‘আমার উদ্দেশ্য খুব সহজ। মানুষের সেবা করে শান্তি পাই। তবে আমি পাকা রাজনীতিবিদ নই। সে পর্যায়ে ভাবলে আমার প্রতি অবিচার হবে। রাজনীতিতে আমার অভিজ্ঞতা একেবারে নতুন। এখানে আমি ভালো কাজ করতে চাই। সামনে দেখা যাবে, কতটা কী করতে পারি।’
তবে রাজনীতিতে নতুন হলেও আধাঘণ্টার এই সংবাদ সম্মেলন মাশরাফি সামলান পাকা রাজনীতিবিদের মতো। কোনো বেফাঁস কথা নেই, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে নেই হুংকার, ‘একবারও বলিনি আমি আমার প্রতিপক্ষের চেয়ে ভালো। তাঁকে বরং আমি সম্মান করি। আরেকজনকে ছোট করে আমি বড় হব, সেই সুযোগ নেই। দেখুন, আমি একজন স্পোর্টসম্যান। রাজনীতিতেও এই স্পোর্টিং মানসিকতা কিছুটা থাকতে হবে।’
ক্রিকেট ময়দানের মানসিকতা রাজনীতির মঞ্চে নিতে যেতে চান মাশরাফি। পারবেন, কি পারবেন না—সে উত্তর সময়ের হাতে। তবে রাজনৈতিক অঙ্গনে সে মানসিকতারই তো এখন বড্ড অভাব। সে কারণেই ক্রিকেট-পরবর্তী জীবনে মাশরাফির যতটা রাজনীতি প্রয়োজন, এর চেয়ে ঢের বেশি হয়তো রাজনীতিরই প্রয়োজন মাশরাফিকে।