শুরুর কথাঃ বিশ্বের প্রায় ১৫৭ কোটি মুসলিমের মধ্যে প্রতিবছর প্রায় ৫ কোটি ডায়াবেটিসের রোগী রমজান মাসে রোজা পালন করেন।
৯০.৩৯% মুসলমানের বাংলাদেশে ডায়বেটিস রোগির সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ।
আপাতদৃষ্টিতে একজন সুস্থ ও সুনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের রোগীর রোজা পালন করতে কোনো বাধা নেই।
কিন্তু রমজান মাসে
১।পরিবর্তিত খাদ্যাভ্যাস,
২।ব্যায়ামের ধরন ও
৩।ডায়াবেটিসের ওষুধ বা ইনসুলিনের পরিবর্তিত মাত্রা ও সময় সঠিকভাবে জেনে নিয়ে একজন ডায়াবেটিস রোগী রোজা পালনের জন্য সঠিকভাবে তৈরি হয়ে নেবেন।
রোজা পালনে ঝুঁকি আছে কাদের?
রমজান মাস শুরু হওয়ার অন্তত দুই থেকে তিন মাস আগেই পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতে।
প্রথমেই জেনে নিন আপনার রোজা পালনে কোনো বাধা আছে কি না। ডায়াবেটিস রোগী যাদের নিচের যেকোন সমস্যা থাকলে রোজা পালনে বিরত থাকতে হবে ( ২০১৬ সালে IDF-DAR নির্ধারিত এবং মিশরের বিজ্ঞ মুফতিগন ও আল আযহারের ইসলামি ব্যক্তিত্ব দ্বারা স্বীকৃত)।
কারণ এ সকল রোগীদের দীর্ঘ সময় অভুক্ত থাকার জন্য হাইপোগ্লাইসেমিয়া(সুগার কমে যাওয়া) বা হাইপারগ্লাইসেমিয়া (সুগার মাত্রার চেয়ে বেশী) হয়ে জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।
১। যাদের হাইপোগ্লাইসেমিয়ার (রক্তে সুগার মাত্রার চেয়ে কমে যাওয়া) আশঙ্কা যাদের বেশি---
★ রোজার আগে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার জন্য ভর্তি হতে হয়েছিলেন ;
★ যাদের বার বার হাইপোগ্লাইসেমিয়া হবার ইতিহাস আছে
★ গত তিন মাসের মধ্যে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার কারণে অজ্ঞান হওয়া রোগী
★ যাঁরা হাইপোগ্লাইসেমিয়ার (রক্তে সুগার কম) আলামত টের পায় না/ অসচেতন।
২। যাঁদের রক্তে সুগার একেবারেই অনিয়ন্ত্রিত,
৩। যাঁরা যকৃত, কিডনি, হার্ট, মস্তিষ্ক ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত,
৪।ডায়ালাইসিস করছেন, এমন রোগী,
৫। অত্যধিক বয়স্ক ও ভীষন অসুস্হ রোগী।
৬। ডায়াবেটিস রোগী যাদের স্মৃতিলোপ / অনিয়ন্ত্রিত খিচুনি আছে।
৭। গর্ভবতী ডায়াবেটিসের রোগী যাদের ঔষধ / ইনসুলিন প্রয়োজন ।
৮। টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগী যাদের বারবার ইনসুলিন নেওয়া প্রয়োজন।
( নিজের সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে রমজানের দুই থেকে তিন মাস আগে একটি সম্পূর্ণ চেকআপ করা উচিত । এ সময় রক্তের সুগার, সুগারের তিন মাসের গড় মাত্রা বা HbA1C, কিডনি ও লিভার পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া উচিত। এসব পরীক্ষার রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে আসন্ন রোজা পালনের পরিকল্পনা নেয়া উচিত ।)
রমজানে_ডায়াবেটিস_রোগীর_সতর্কতা_কেন_প্রয়োজন?
রমজানের সময় ও অন্তত তিন মাস আগ থেকে সঠিকভাবে প্রস্তুতি ও শিক্ষা না নিলে নিচের বিপদ ঘটতে পারে -
১! হঠাৎ করে রক্তে সুগার অনেক কমে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন অর্থাৎ হাইপোগ্লাইসেমিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন।
★ রোজা রাখলেই হাইপো হবে এ ধারণা ঠিক না।
★ ডায়াবেটিসের ওষুধ না খেলে ডায়াবেটিস রোগীর হাইপো হয় না।
★ ১২-১৪ ঘণ্টা না খেয়ে থাকলেও কারও হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয় না।
★ যারা সালফোনিলুরিয়া ট্যাবলেট খান ও ইনসুলিন নেন তাদের হাইপো হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। তাই ওষুধ ও ডোজ অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে হয়।
২! রক্তে সুগার অনিয়ন্ত্রিত হয়ে ডায়াবেটিক KETOACIDOSIS বা COMA হতে পারে-
কারন-
★ হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ভয়ে ওষুধ অনেকেই বাদ দেন বা অনেকে অযৌক্তিকভাবে কমিয়ে দেন।
★ পরিশ্রম কম করে বিধায় সুগার বেশি হয়ে যায়।
★ইফতারের পর বেশী ও গ্লুকোজ সমৃদ্ধ খাবার এবং পার্টিতে ভোজন বেশী করা।
৩! পানিশূন্যতা ও
৪! থ্রম্বোসিসে আক্রান্ত হতে পারেন।
#রমজানের_খাদ্যাভ্যাসঃ
যা করতে হবে --------------
★ একজন ডায়াবেটিসের রোগী রমজানের আগে যে পরিমাণ ক্যালরি গ্রহণ করতেন, রমজান মাসেও তা করবেন , কেবল এর সময়সূচি ও উপাদান পরিবর্তিত হবে।
★ নাস্তা যদি ইফতার হয় ডিনার যদি সেহেরি হয় তারাবির পর যদি লাঞ্চ করি তাহলে সমস্যা নেই।
★ ইফতারির সময় সুষম ও পুষ্টিকর পরিমিত আহার ও তরল গ্রহণ করতে হবে।
★ সুষম খাবার বলতে কার্বোহাইড্রেট ৪৫-৫০%, প্রোটিন ২০-৩০%, ফ্যাট <৩৫% হতে হবে।
★ সেহরী অবশ্যই শেষ রাতে খাবেন এবং ভাত/ রুটিসহযোগে যথেষ্ট পরিমাণে আমিষ, ফ্যাট ও সারা দিনের প্রয়োজনীয় তরল খাদ্য গ্রহণ করুন।
★ শুধু ডায়াবেটিস রোগী নয়, সবার জন্য ফল খাওয়া ভালো। ফলে ফ্রুক্টোজ থাকে। ফ্রুক্টোজ স্বাদে চিনির মতো মিষ্টি কিন্তু এতে গ্লুকোজ কম।
ডায়াবেটিক রোগীর প্রতিদিন একটা মিষ্টি ফল খাওয়া উচিত। টক ফল খাওয়া খুব ভালো। রোজার দিনে খেজুর পরিমাণমত (প্রতিদিন ৩/৪ টা) খেতে পারেন ।
★ গরমের দিনে রোজা এবং দিন বড়। পানির ব্যাপারে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে। পানি সমৃদ্ধ ফল শসা, টমেটো, তরমুজ ও ডাব বেশি খেতে হবে। রাতের বেলা, সন্ধ্যা শুরু থেকে সেহেরির শেষ ওয়াক্ত পর্যন্ত পর্যাপ্ত পানি খাবেন।
★সেহরী, সেহরীর শেষ সময়ের কাছাকাছি খাবেন।
★ রক্তে দ্রুত সুগার ধীরে ধীরে বাড়ায় ( low glycemic index Food) , এমন খাবার -----লাল আটা, লাল চালের ভাত, গোটা শস্য, শস্যবীজ ইত্যাদি, রোজার মাসে বিশেষ করে সেহেরীতে পরিমিত গ্রহণ রক্তে সুগারের মাত্রা দীর্ঘক্ষণ ধরে সুষম রাখতে সাহায্য করবে।
যা করা যাবে না ---------------------
★ হাই ক্যালরি ও রক্তে দ্রুত সুগার বাড়ানো খাদ্য (high glycemic index food) যত সুস্বাদু ও মুখরোচকই হোক না কেন যেমন জিলাপি, লাড্ডু, শরবত, হালুয়া, কেক, আলুনি, সফট ড্রিংক ইত্যাদি থেকে বিরত থাকুন।
★ বেশি পরিমাণে তেল আছে এমন খাবার, যেমন—কাবাব, বেগুনি, পেঁয়াজু বা ভাজাপোড়ায় কেবল ওজনই বাড়াবে না, রক্তে চর্বি বাড়িয়ে দেবে এবং পেটে বদহজম ও গ্যাস সৃষ্টি করবে। এগুলো পরিহার করুন।
★ ইফতারির সময় ও পরে হঠাৎ করে বেশি পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ বা ভূরি ভোজ করবেন না।
★ নির্দিষ্ট সময় ছাড়া বারবার খাবেন না।
★ সেহির না খেয়ে কোনো অবস্থাতেই রোজা রাখা উচিত নয়।
★ সময় হবার আগে সেহরি খাবেন না। অনেকে রাত ১২টার দিকে সেহরি খান।
★ ১৬০০ ক্যালোরীর একটি নমুনা খাদ্য তালিকাঃ
ইফতার ----
* ডাবের পানি / চিনিবিহীন লেবুর / টক ফলের শরবত- ১ গ্লাস।
* ফল- ১ ভাগ বা খেজুর ২ টা।
* মুড়ি -১ কাপ।
* পিয়াজু - ১ টা।
* বেগুনি -১টা।
* ছোলা আধা কাপ।
* ইচ্ছেমত খাবেন - পানি/ ডাবের পানি /তরমুজ / টিক ফল।
সন্ধা রাত-------
* রুটি - ছোট পাতলা ২ টা/ ভাত - দেড় কাপ।
* মাছ/ মাংস / ডিম -১ টা।
* ডাল- ১ কাপ।
সেহরি --------
* ভাত - ২ কাপ।
* মাছ/ মাংস - ২ পিচ।
* ডাল-১ কাপ।
* দুধ - ১ কাপ।
* শাক সবজি, সালাদ, পানি ইচ্ছেমত।
#রমজানে_ব্যায়াম_কিভাবে_করবেনঃ
১/ সন্ধ্যার পর হালকা ব্যায়াম বা আধা ঘণ্টা হাঁটা যেতে পারে।
২/ যাঁরা নিয়মিত দীর্ঘ ২০ রাকাত তারাবির নামাজ পড়ে থাকেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এটিই ব্যায়ামের বিকল্প, আলাদা করে ব্যায়ামের প্রয়োজন নেই।
৩/ রোজা রেখে দিনের বেলা অতিরিক্ত পরিশ্রম ও ব্যায়াম না করাই ভালো। এতে রক্তে সুগার হঠাৎ কমে যেতে পারে এবং অতিরিক্ত ঘাম হওয়ার কারণে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে।
#রোজা_রেখে_রক্তের_সুগার_মাপলে_কি_রোজা_ভেঙে_যাবে❓
★ বিশ্বের বড় বড় ইসলামি চিন্তাবিদ ও আলেমগণ আগেই রায় দিয়েছেন যে রোজা রেখে রক্তে সুগার পরীক্ষা করালে তাতে রোজা ভেঙে যায় না। রমজান মাসে বাড়িতে গ্লুকোমিটারে মাঝেমধ্যে নিজের রক্তের সুগার নিজে মেপে দেখুন।
★ রোজাদার ব্যক্তি চামড়ার ইনসুলিন নিলে রোজা ভাংবেনা। যারা ইনসুলিন নেন আজানের ২০ মিনিট আগে নিতে পারেন।
★ অন্তত সপ্তাহে এক বা দুই দিন দিনের মাঝামাঝি এবং ইফতারির আগে ও ইফতারের দু'ঘন্টা পরে সুগার মাপুন।
★ সেহিরর পর সুগার ০৮ মিলিমোল বা এর কম এবং ইফতারির আগে ০৬ মিলিমোল বা এর কম থাকা বাঞ্ছনীয়।
★ এর মধ্যে দিনের যেকোনো সময় খারাপ লাগলে বা শরীর কাঁঁপলে, ঘেমে উঠলে, মাথা ফাঁকা লাগলে অবশ্যই সুগার মাপুন।
#আমি_মরে_গেলেও_রোজা_ভাঙব_না!!
★ দিনের যেকোনো সময়ে সুগার ৩.৩ মিলিমোল বা তার কম এবং দিনের পূর্বাহ্নেই ৩.৯ মিলিমোল বা তার কম হয়ে গেলে সেদিন রোজা ভেঙে ফেলতে হবে।
★ দিনের যেকোনো সময় রক্তে সুগার ১৬.৭ মিলিমোলের বেশি হয়ে গেলেও রোজা ভাঙতে হবে। এতে রোগি যেকোন সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে এবং হলে অতি সত্বর ডক্টরের পরামর্শ নিতে হবে।
#ওষুধ_ও_ইনসুলিনের_মাত্রা_ও_সময়_জেনে_নিন
💊💉
★ রমজান মাসে ডায়াবেটিসের ওষুধ ও ইনসুলিনের মাত্রা ও সময়সূচি পরিবর্তন করা প্রয়োজন।
★ সোজা নিয়মে ইনসুলিনের সকালের ডোজটি দেওয়া হয় ইফতারির সময় এবং রাতের ডোজটি অর্ধেক করে শেষ রাতে দেওয়া হয়
★ এক বেলার মুখের ঔষুধ ইফতারে, দুবেলার মুখের ঔষুধ সেহরি ও ইফতারে নেওয়া যেতে পারে।
★ কোন ওষুধ এবং কোন ধরনের ইনসুলিনের জন্য কোন ধরনের পরিবর্তন ঠিক কোন রোগীর জন্য প্রযোজ্য হবে, তা চিকিৎসকই বলতে পারবেন। কাজেই রমজানে নিজের ওষুধের মাত্রা ও সময় জেনে নেওয়ার জন্য আগে থেকেই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নিন।
শেষ কথাঃ আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সুস্থতা সহকারে সঠিক পদ্ধতিতে রামাযানের সম্পূর্ণ রোযা পালন ও এর তাৎপর্য বুজবার তাওফীক দান করুন। আমীন।