#শুরুর_কথাঃ
কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কাজ স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্রুতগতিতে চলছে। রোগটির প্রাদুর্ভাবের মাত্র দুই মাসের মাথায় গত মার্চে একটি ভ্যাকসিন মানব শরীরে প্রয়োগ করে ট্রায়াল শুরু হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, মে মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত সারাবিশ্বে অন্তত ১১০টি ভ্যাকসিন প্রাক-মূল্যায়নের পর্যায়ে রয়েছে এবং ৮টি ভ্যাকসিন মানবশরীরের প্রয়োগ করে ট্রায়ালের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে ।

#বিজ্ঞানীরা কীভাবে কাজ করছেন?

ভ্যাকসিন মূলত মানব শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সঙ্গে ওই নির্দিষ্ট জীবাণুটির পরিচয় ঘটিয়ে দেয়।
নভেল করোনাভাইরাসকে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা চিহ্নিত করেতে ভ্যাকসিন প্রস্তুতে বিজ্ঞানীরা ভাইরাসের রোগ তৈরির ক্ষমতা নষ্ট করে দেন এবং
★ একটি দুর্বলতর কিন্তু সক্রিয় ভাইরাস ব্যবহার করেন, অথবা
★ একটি মৃত বা নিষ্ক্রিয় ভাইরাস ব্যবহার করেন, অথবা
★ ভাইরাসটির একটি উপাদান বা অংশ যেমন প্রোটিন বা সুগার ব্যবহার করেন।

এর ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ( IMMUNE SYSTEM) জীবাণুটিকে চিনতে পারে ও লড়াই করে এবং ভাইরাসকে নিস্ক্রিয় করে।

#ভ্যাকসিনের প্রি-ক্লিনিক্যাল মূল্যায়ন
(PRE-CLINICAL TRAIL)

পরীক্ষাগারে একটি ভ্যাকসিন তৈরির পর বা সেটির কার্যকারিতা সম্পর্কে সম্ভাবনা জাগলে তা প্রাণীর শরীরে প্রয়োগ করে পরীক্ষা করা হয়।
এতে দেখা হয় এটি নিরাপদ ও কার্যকর কি না।
প্রাণীদেহে প্রয়োগের এ পর্যায়ই হলো প্রি-ক্লিনিক্যাল মূল্যায়ন।
প্রাণীদেহে পরীক্ষা শেষ হতে সাধারণত তিন থেকে ছয় মাস সময় লাগে।
প্রি-ক্লিনিক্যাল মূল্যায়নে যা দেখা হয়-
★ ভ্যাকসিনে কোনো বিষাক্ত উপাদান ব্যবহার করা হয়নি
★ ট্রেস ইমপিউরিটিজের সঙ্গে বিক্রিয়া করে কোনো বিষাক্ত প্রতিক্রিয়া তৈরি করে কি?
★ ভ্যাকসিনটি শরীরে প্রয়োগ করায় অন্য ভ্যাকসিনের সঙ্গে নেতিবাচক ক্রিয়া করে কি?
★ ভ্যাকসিনের প্রয়োজনীয় ডোজও নির্ধারণ করা হয়।

#ক্লিনিক্যাল_ট্রায়ালঃ
(CLINICAL TRIAL)
প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সফলের পর (প্রাণীর শরীরে যখন কোনো ভ্যাকসিন নিরাপদ ও কার্যকর প্রমাণ হয়), তখন মানবদেহে প্রয়োগ করা হয়। একে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বলে ।
কারন,
মানব শরীরের ভাইরাসের সংক্রমণ বা ভ্যাকসিনের প্রয়োগ হলে যে রকম প্রতিক্রিয়া হয় প্রাণীর শরীরের একই রকম প্রতিক্রিয়া নাও হতে পারে।
এই ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ৪ টি পর্যায়ে বা ফেজে করা হয়-

1⃣ প্রথম পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা ফেজ-১ ক্লিনিক্যাল ঃ

★ এ পর্যায়ে সাধারণত ১০ থেকে ১০০ জন পর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবী #স্বাস্থ্যবান প্রাপ্ত-বয়স্কের ওপর ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। এমনকি যদি ভ্যাকসিনটা অন্য বয়েসের মানুষের জন্যও তৈরি করা হয় যেমন বৃদ্ধ বা শিশু- তবুও ভ্যাকসিন প্রথমে প্রাপ্তবয়স্কদের শরীরেই প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।
এ পর্যায়ে যা নিশ্চিত হতে চায়- (is it SAFE?)
★ ভ্যাকসিনটি নিরাপদ কি না?
★ কোন বিষক্রিয়া হয় কি না?
★ ভ্যাকসিন শরীরের উপর কিভাবে কাজ করে?
★ শরীর কিভাবে ভ্যাকসিনের প্রতি প্রতিক্রিয়া করে।

এ পর্যায়ের স্বেচ্ছাসেবীরা সাধারণত ৬ থেকে ১২ মাস পর্যন্ত পর্যবেক্ষণে থাকেন।
তবে ভ্যাকসিনটি নিরাপদ মনে হলে প্রথম পর্যায়ের ট্রায়াল শুরুর কয়েক সপ্তাহ পর, ট্রায়াল শেষ হওয়ার আগেই দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শুরু করা যায়।

2⃣ দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা ফেজ -২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ঃ

বৃহত্তর পরিসরের দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে কয়েকশ নির্দিষ্ট বয়েসের স্বেচ্ছাসেবী স্বাস্থ্যবান/রোগী অংশ নেন।
এই পর্যায়ে যেসব মূল প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়-
★ এটি কার্যকর কি না? (Does it WORK?)
★ সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী কী হচ্ছে?
★ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে?
★ ভ্যাকসিনের সর্বোত্তম ডোজটি কত এবং এটি কখন প্রয়োগ করা উচিত?

3⃣ তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা ফেজ -৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ঃ

ভ্যাকসিনের তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে সবচেয়ে বেশি স্বেচ্ছাসেবী স্বাস্থ্যবান/রোগী যুক্ত হয়ে থাকেন। এ পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে প্রায় ৩০ হাজার জনের শরীরে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। সব বয়েসি সন্দেহভাজন আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়।
এই পর্যায়ে মূল যেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজা হয়-
★ ভ্যাকসিনটির ঝুঁকির ( পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া/ক্ষতিকর) চেয়ে সুবিধা ( রোগ প্রতিরোধে কার্যকর) বেশি কি না? ( লাভ ক্ষতি বিবেচনা করা হয়)।
তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শেষ হতে প্রায় তিন বছর লেগে যায়।

4⃣ ফেজ-৪ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ঃ

# একবার ভ্যাকসিন অনুমোদিত হয়ে গেলে কি গবেষণা শেষ?
উত্তর ঃ না।
ফেজ -৩ ট্রায়ালের অনুমোদনের পর
ভ্যাকসিন বাজারে আসে এবং বিশাল সংখ্যক সাধারন মানুষের শরীরে ব্যবহার হয়ে থাকে।
এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ও প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণে রাখা হয়।
(Post Marketing Surveillance)
একে ফেজ-৪ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বলে।
কারন,
বিশালসংখ্যক মানুষের শরীরের প্রয়োগের ফলে কিছু কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখাও দিতে পারে, যা হয়তো ফেজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে সীমিত সংখ্যক মানুষের শরীরের নাও দেখা দিতে পারে।

#কে_কীভাবে_ভ্যাকসিন_অনুমোদন_দেয়?

★ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিয়ে থাকে ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (FDA).
★ কানাডায় এই অনুমোদন দেয় বায়োলজিক্যাল রেডিওফার্মাসিউটিক্যালস ড্রাগস ডিরেক্টরেট।
★ যুক্তরাজ্যে মেডিসিনস অ্যান্ড হেলথকেয়ার প্রোডাক্টস রেগুলেটরি এজেন্সি (MHRA),
★ ইউরোপের দেশগুলোর জন্য ইউরোপ মেডিসিন এজেন্সি (EMA) এই অনুমোদন দিয়ে থাকে।
★ বাংলাদেশে অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (BMRC)।

এছাড়া ভ্যাকসিন অনুমোদনের জন্য যেসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়, সেগুলোও মোটামুটি সব দেশে একই রকম। এই বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে-
★ ফেজ-১ঃ ভ্যাকসিনটি নিরাপদ কি না
★ ফেজ-২ঃ এটি কার্যকর কি না
★ ফেজ-৩ঃ ভ্যাকসিনটির ঝুঁকির চেয়ে সুবিধা বেশি কি না
★ফেজ-৩ঃ ভ্যাকসিন ব্যবহার শুরু হলে নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি কেমন?

#চীনা_ভ্যাকসিনের ফেজ-৩ ট্রায়ালঃ চীনের সিনোভেক বায়োটেক কোম্পানির করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিনের (করোনাভেক) দুইটি ধাপের ট্রায়াল এরইমধ্যে সেখানে সফল হয়েছে৷ এবার বাজারজাত করার আগের ধাপে মানবদেহে পরীক্ষার পালা (ফেজ-৩ ট্রায়াল)৷
বাংলাদেশে এই ভ্যাকসিনের মানবদেহে কার্যকারিতা পরীক্ষা করবে ICDDRB৷ এজন্য নৈতিক (এথিক্যাল) অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (BMRC)৷
তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শুরু হতে পারে তিন সপ্তাহের মধ্যেই৷ সাতটি হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর এই পরীক্ষা চালানো হবে৷ ট্রায়াল শেষ হতে লাগবে ১৮ মাস৷
এটি সফল হলে বাংলাদেশ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চীন থেকে ভ্যাকসিন পাবে।

#অক্সফোর্ড_ভ্যাকসিনঃ
যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ওষুধ উৎপাদনকারী অ্যাস্ট্রাজেনেকার পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন প্রথম ভ্যাকসিন হিসেবে চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছেছে। এটি কোভিড-১৯ থেকে মানুষকে কতটা কার্যকরভাবে সুরক্ষা দিতে পারে, তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি এটি দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলেও পরীক্ষা করা হচ্ছে।
পরীক্ষা সফল হলে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন গ্রুপ আশা করছে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ তারা কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ছেড়ে দিতে পারবে।
যুক্তরাজ্য ইতিমধ্যে এই টিকার ১০ কোটি ডোজের অগ্রিম ফরমাশ দিয়ে রেখেছে।

#শেষ_কথাঃ
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন –
” আমি যখন অসুস্থ হই, তখন তিনিই (আল্লাহ) আমাকে আরোগ্য করেন “।
আল্লাহ উপর ভরসা করেই আমরা রোগমুক্তির জন্য সকল প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করব ( ফেস মাস্ক, গ্ল্যাভস, স্যানিটাইজার, সোশ্যাল ডিসট্যান্স, চিকিৎসা ও ভ্যাকসিন)।
মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে করোনা সহ সকল রোগ, আযাব ও গজব থেকে মুক্তি দান করুন।

লেখকঃ
ডাক্তার এটিএম জাবেদ হাসান
সহকারী অধ্যাপক
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতাল