ইতিহাসঃ করোনাভাইরাস ১৯৬০-এর দশকে প্রথম আবিষ্কৃত হয়। প্রথমদিকে মুরগির মধ্যে সংক্রামক ব্রঙ্কাইটিস ভাইরাস হিসেবে এটি প্রথম দেখা যায়।
পরে সাধারণ সর্দিকাশিতে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এরকম দুই ধরনের ভাইরাস পাওয়া যায়।
মানুষের মধ্যে পাওয়া ভাইরাস দুটি
১/ ‘মনুষ্য করোনাভাইরাস ২২৯ ই’ (Human Corona Virus 229E) এবং
২/ ‘মনুষ্য করোনাভাইরাস ওসি৪৩’ (Human Corona Virus OC43) নামে নামকরণ করা হয়।
এরপর থেকে বিভিন্ন সময় ভাইরাসটির আরও বেশ কিছু প্রজাতি পাওয়া যায় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো –
২০০৩ সালে ‘SARS-CoV,
২০০৪ সালে ‘HCoV-NL63’,
২০০৫ সালে ‘HKU1’,
২০১২ সালে ‘MERS-CoV- মধ্যপ্রাচ্যে ( বিশেষ করে সৌদি আরবে) এই ভাইরাসের এক মহামারী দেখা গিয়েছিল, তাকে বলা হতো মার্স করোনা ভাইরাস ( Middle East respiratory syndrome Corona virus)।
এবং
সর্বশেষ ২০১৯ সাল চীনে ‘নোভেল করোনাভাইরাস’।
বর্তমান মহামারীর পূর্বে প্রায় ৮৫০০ জন করোনা ভাইরাসের রোগী সনাক্ত হয়েছিল।
তার মধ্যে মারা গিয়েছিল প্রায় ৮০০ জন (প্রায় ১০% fatality) ।
#বর্তমান_মহামারীঃ★ ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে নোবেল করোনা ভাইরাসের সংক্রামণ দেখা দেয়।
★ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ভাইরাসটিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ‘২০১৯-এনসিওভি’ (NCoV- Nobel Corona Virus )নামকরণ করে।
★ এ বছর এখন পর্যন্ত চীনের সঙ্গে আরও ১২টি দেশে সংক্রমণের খবর পাওয়া যায় যাতে প্রায় ১০০ জনের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে।
#গঠন_ও_নামকরন_কিভাবে?
*প্রতিটি বিষয়েরই নামকরণের একটি ইতিহাস কিংবা প্রেক্ষাপট থাকে।
* করোনা ভাইরাস ( Corona Virus ) শব্দটি ল্যাটিন করোনা থেকে নেওয়া হয়েছে যার অর্থ মুকুট।
* এই ভাইরাসের গঠনগত দিক থেকে এর নামকরণ করা হয়েছে ।
* কারণ ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ভাইরাসটি দেখতে অনেকটা মুকুটের মত এবং ব্যাঙের ছাতার মত Halo (Corona) সাজানো থাকে ।
* ভাইরাসের উপরিভাগে প্রোটিন সমৃদ্ধ থাকে যা ভাইরাল স্পাইক পেপলোমার দ্বারা এর অঙ্গসংস্থান গঠন করে।
* এ প্রোটিন সংক্রামিত ( infection) হওয়া টিস্যু বিনষ্ট করে।
* সকল প্রজাতির করোনাভাইরাসে সাধারণত স্পাইক (S), এনভেলপ (E), মেমব্রেন (M) এবং নিউক্লিওক্যাপসিড (N) নামক চার ধরনের প্রেটিন দেখা যায়।
* এর ভিতরে একটা Single stranded RNA থাকে । এটার দুইটা সাবটাইপ আছে- 229E এবং OC43
★ যেসব ভাইরাস গুলো RNA দিয়ে তৈরী, তারা কুখ্যাত চরিত্রের হয়ে থাকে , যেমন- HIV, Hepatitis C, Influenza, Rabies, Ebola, Dengue, Polio ইত্যাদি।
★ সম্প্রতি এই দলে যোগ হয়েছে নতুন নাম- Corona virus.
#কিভাবে_কখন_সংক্রমণ_হয়ঃ
* ধারণা করা হচ্ছে, এই ভাইরাস প্রথম ছড়িয়েছে কোনো বন্যপ্রাণীর দ্বারা, হতে পারে সেটি কোনো সাপ। সাউথ চীনা সি ফুড হোলসেল মার্কেট এ এই সাপ খেয়েই একজনের মাধ্যমে এই রোগ ছড়িয়েছে।
* এই ভাইরাস ছড়ায় বাতাসে হাচি কাশি ও শ্বাস নিঃশ্বাসের মাধ্যমে । তাই রোগীদের Facial Mask ব্যবহার করা উচিত।
* আক্রান্ত ব্যক্তি ছুঁয়েছে এমন কিছু স্পর্শ করার পর সেই হাত দিয়ে মুখ, নাক বা চোখ স্পর্শ করলে সংক্রমণ হতে পারে।
* কফ ও শ্লেষা যুক্ত হাতের Handshake এর মাধ্যমে এরোগ ছড়াতে পারে। তাই রোগ বিস্তার প্রতিরোধে ভালো করে হাত ধৌত করা প্রয়োজন।
* শীতকালেই এর প্রকোপ দেখা যায়।
* ধরে নেয়া হয়- বাদুর এই ভাইরাসের একমাত্র রিজার্ভার (Virus Bank)।
#কিভাবে_রোগ_ তৈরি_করে
* এই ভাইরাসটি মূলত নাক এবং মুখ দিয়ে শরীরের ভিতরে প্রবেশ করে।
* শরীরে ভাইরাস প্রবেশের পর ( Incubation period) ৩ থেকে ১০ দিন পর রোগের উপসর্গ দেখা যেতে পারে। এজন্য মহামারী কোন এলাকা থেকে কোন ব্যক্তির আগমনের ২ সপ্তাহ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণে রাখা হয়।
* এই ভাইরাসের ইনফেকশনে ৫০% মানুষের কোনো সিম্পটমই প্রকাশ পায় না । অনেক সুস্থ্য বাচ্চাদের শরীরে এই ভাইরাসের এন্টিবডি তার উপযুক্ত প্রমাণ।
* এই ভাইরাসের ইনফেকশন মূলত ফুসফুসের Epithelium কেন্দ্রিক, এর বাইরে অন্য কোন অংগ আক্রান্ত হয় না ।
* সংক্রমণের পরে এটি ফুসফুসের একটি ‘Host Cell’ বা সহায়ক কোষকে বেছে নেয়। এরপর সেই সেলটি বিস্ফোরণ ঘটার মাধ্যমে কাছাকাছি কোষগুলোকে আক্রান্ত করতে শুরু করে।
#কি_রোগ_তৈরি_করতে_পারে?
#কেন_এত_ভয়ংকর?
* আমাদের যে সাধারন সর্দি কাশি ( Common Cold) হয় Rhinovirus দিয়ে, করোনা ভাইরাস দিয়েও একই রকম সর্দি কাশি, নাক দিয়ে পানি পড়া, জ্বর, মাথা ব্যাথা হয়।
* কিন্তু সিরিয়াস ফর্মে গেলেই নিউমোনিয়া (Atypical Pneumonia) এর রূপ ধারন করে । যাকে Severe Acute respiratory syndrome বা SARS বলে। তাই অনেকে একে সার্স ভাইরাসও বলে থাকে ।
* এই রোগে আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগীর মৃত্যু হয় এই জটিলতায় ( Pneumonia, SARS) ফলে মারাত্মক শ্বাসকষ্ট হয়।
* যার ফলে ফুসফুসে রক্তপ্রবাহে আর অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারে না। যার ফলে Severe Hypoxia দেখা যায় । অক্সিজেনের অভাবে অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে মৃত্যু ঘটতে পারে।
* এই ভাইরাস ফুসফুসের Angitensin Converting Enzyme-2 এর সাথে বাইন্ড করে থাকে , যার ফলে Fluid Balance Dysregulation হয়।
#কি_পরীক্ষা_করা_হয়?
* Blood এ WBC, Platelet Count কমে যায়।
* CXR : chest Xray করলে Ground Glass Infiltration পাওয়া যায়, কিন্তু কোনো Cavitation পাওয়া যায় না ।
* PCR অথবা এন্টিবডি টেস্ট দিয়ে রোগ কনফার্ম করা যায় ।।
#প্রতিকার( Treatment) :
* এর কার্যকরী চিকিৎসা এখনো আবিষ্কার হয় নাই ।
* উপসর্গ ভিত্তিক চিকিৎসা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অকার্যকর।
#প্রতিরোধ (Prevention ):
* যেহেতু এই ভাইরাসের কার্যকরী চিকিৎসা নেই, তাই এর প্রধান চিকিৎসা হল প্রতিরোধ ।
* ঠান্ডা জনিত বিভিন্ন রোগ যেমন, জ্বর, কাশি, শর্দি, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি হলে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে ।
রোগ প্রতিরোধে নিচের পদক্ষেপ জরুরী –
★ প্রথমে আপনার হাতদুটোকে সবচেয়ে বেশি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
সাবান, হ্যান্ডওয়াশ, স্যানিটাইজার দিয়ে নিয়মিত হাত ধুতে হবে।
বিশেষত হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হাঁচি-কাশি দেওয়া এবং টয়লেট থেকে ফেরার পরে।
শুধু তাই নয়, খাবার তৈরি প্রক্রিয়ার আগেও হাত ভালোভাবে ধুয়ে নেবেন।
ফ্লু বা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী দেখাশোনা এবং তাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র ধরার পর হাত ধুতে হবে।
★ হাত দিয়ে সরাসরি চোখ এবং নাক চুলকানো বা খোটাখুটি করা থেকে বিরত থাকুন।
★ জনবহুল এলাকায় অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করুন। বিশেষ করে কোনো উৎসব বা উপলক্ষ্যে যেখানে বহুলোকের সমাগম হয়।
★ ভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকবেন।
সম্ভব হলে আক্রান্তের কয়দিন রোগীর সঙ্গে দেখা করবেন না, তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র নাগালের বাইরে রাখবেন।
★ হাঁচি এবং কাশি দেওয়ার সময়ে অবশ্যই টিস্যু বা রুমালে নাক এবং মুখ ঢেকে নেবেন।
ব্যবহৃত টিস্যু যেখানে-সেখানে না ফেলে ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট স্থানে ফেলুন, তারপর হাত ধুয়ে ফেলুন।
হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় হাতের কাছে রুমাল বা টিস্যু না পেলে হাতের বাহু (কনুইয়ের উপরে) দিয়ে নাক মুখ ঢেকে নিন।
★ যেসব দেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে সেসব দেশ ভ্রমন করা থেকে বিরত থাকা, অথবা যারা ঐ সব দেশ থেকে আসে, তাদের ভালো করে পরীক্ষা করা ও চিকিৎসা করা প্রয়োজন।
★ ফল এবং সবজি খাওয়া, রান্নার আগে ভালোভাবে পরিস্কার পানি দিয়ে ধুয়ে নেবেন।
★ ভালো খাদ্যাভাস এবং ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে তুলুন। আর শরীরের রোগ প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য পর্যাপ্ত ঘুমাতে চেষ্টা করুন।
#শেষ_কথাঃ
Prevention is better as NO cure.
গ্লোবালাইজেশনের যুগে রোগ Pandemic হতে সময় লাগে না। তাই সবার সচেতনতাই পারে এই করোনা ভাইরাস ভয়ঙ্কর ছোবল থেকে সবাইকে রক্ষা করতে।
আল্লাহ আমাদের সকলকে রক্ষা করুন।
লেখকঃ
ডাক্তার এটিএম জাবেদ হাসান
সহকারী অধ্যাপক
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতাল